Thursday 14 August 2014

শহীদ আব্দুল মালেক, একটি নাম, একটি ইতিহাস



(পর্ব-১)

"যখন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে তুমি
হেসেছিলো সবে।
এমন জীবন তুমি করিও গঠন
মরণে হাসিবে তুমি
কাদিবে ভুবন।”
-কাজী নজরুল ইসলাম

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল। মাত্র ২২ বছর। এই ছোট্র জীবনে শহীদ আব্দুল মালেকের একেকটি কর্ম যেন একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে। তার কর্মময় জীবন ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর জন্যই অনুপ্রেরণা। তিনি জীবনে যেমন একটি সুন্দর ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন ,তেমনি ইসলমী আন্দোলনের প্রয়োজনে সে ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাছে সকল বাধা তুচ্ছ,সকল পিছুটান নিঃস্ব। যা হোক আব্বু তার কাছাকাছি বড় ভাই হওয়ার কারণে তার নিকট হতে অনেক স্মৃতিকথা শুনেছি। সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলদের অনেক স্মৃতিচারণ পড়েছি। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হওয়ার কারণে ক্ষণে ক্ষণে তার মত পাঞ্জেরির প্রয়োজনও অনুূভব করেছি। সব কিছু মিলিয়ে তার কর্মময় জীবনের প্রেরণাময় কিছু অংশ তুলে ধরার জন্যই আমার এ ছোট্র প্রয়াস। আগস্ট মাস জুড়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।



(পর্ব-২)

“অদম্য মেধাবী আব্দুল মালেক”
বাড়ির পাশেই খোকশাবাড়ী স্কুল।পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী সে স্কুলেই ভর্তী করার সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু শিশু আব্দুল মালেক স্কুলে যেতে নারাজ। বড় ভাই আব্দুল খালেক এ ব্যপারে ভর্ৎসনা করায় সে বাড়ি থেকে চলেও গিয়েছিল। পরে বাবা মোহাম্মদ আলী মুন্সী তাকে স্কুলে ভর্তী করানোর ব্যবস্থা করেন। সেই যে স্কুলে যাওয়া, তারপর কোন পিছুটান তাকে দমাতে পারেনি। আব্দুল জলিল সাহেব ছিলেন খোকশাবাড়ী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি শিশু আব্দুল মালেককে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। সবকটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তিনি এতই অভিভূত হলেন যে আব্দুল মালেককে তিনি সরাসরি ২য় শ্রেনীতে ভর্তী করে নিলেন। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গোসাইবাড়ী হাই স্কুল। এলাকার মধ্যে এ স্কুলটির বেশ সুনাম ছিল। শিশু আব্দুল মালেক সে স্কুলে পড়ার আগ্রহ পোষণ করায় তাকে সে স্কুলে ভর্তী করা হল। যে কোন কারণেই হোক প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি আব্দুল মালেক। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষায় তার রেজাল্ট দেখে শিক্ষকরা আফসোস করলেন এবং জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ হতে যেন আব্দুল মালেক বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখলেন। যথারীতি আব্দুল মালেক জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন। আব্দুল মালেক চাচ্ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু গোসাইবাড়ী হাই স্কুলে তখনও বিজ্ঞান বিভাগ ছিল ন। আব্দুল মালেক চাচ্ছিলেন বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেনীতে ভর্তী হতে। ভর্তী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে চাচ্ছিলেন না প্রধান শিক্ষক মুজিবুর রহমান সাহেব। সে দিন আব্দুল মালেকের অদম্য মেধায় অভিভূত হয়ে তিনি বলেছিলেন, দরকার হলে আব্দুল মালেকের জন্য হলেও আমরা আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করব,তবুও তাকে অন্য কোথাও যেতে দিব না। বগুড়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান স্যারের সাথে দেখা করে ভর্তীর কথা জানালে, ভর্তীর জন্য ফরম জমার সময় শেষ হওয়ায় তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দিন স্যারের অনুরোধে তাকে ফরম জমা দিযে ভর্তী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। ভর্তী পরীক্ষায় তিনি ১ম স্থান অধিকার করলেন। স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করে এস এস সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেন। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বাবা মারা গেলেন। পরীক্ষার কারণে তাকে জানতে দেওয়া হল না। মারা যাওয়ার ২ দিন পর বড় ভাই মাস্টার আব্দুল বারী দেখা করতে গেলেন আব্দুল মালেকের সাথে। পরীক্ষার খোঁজ খবর নেওয়ার পর আব্দুল মালেকও বাড়ির খোঁজ জানতে চাইলেন। বড় ভাই কৌশলে জানালেন যেে উপস্থিত সবাই ভাল আছেন। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বাইরে বেশী ঘুরাফিরা না করে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা শেষ করেই বাড়ি আসার জন্য পরামর্শ দিলেন। কারও মাধ্যমে বাবার মৃত্যর খবর জেনে পরীক্ষা যেন খারাপ না হয় সে জন্যেই এমন পরামর্শ দিলেন। পরে পরীক্ষা শেষে বাড়ির নিকটবর্তী হতেই প্রতিবেশীর কাছে বাবার মৃত্যর খবর পেয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। এস এস সি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডে মেধা তালিকায় ত্রয়োদশ স্থান অধিকার করে ভর্তী হলেন, স্বনামধন্য রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী কলেজ থেকে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী হওয়ার আগ্রহ জানালেন। বড় ভাই আব্দুল বারী আব্দুল মালেককে সাথে নিয়ে ঢাকা পৌছলেন বিকাল প্রায় ৩ টার সময়। কিন্তু ২ টার সময় ভর্তী ফরম জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ায় অফিসের কর্মকর্তারা তাদের কিছুই করার নেই বলে জানিয়ে দিলেন। আব্দুর বারী সাহেব চলে আসার পূর্বে তাদেরকে আব্দুল মালেকের একাডেমিক কাগজ পত্রগুলো দেখার অনুরোধ করলেন। অফিসের কর্মকর্তারা কাগজপত্র দেখে বায়োকেমিষ্ট্রি বিভাগের প্রধান ড.কামাল হোসেনকে বিষয়টি জানালেন। কামাল হোসেন নিজেই আসলেন কাগজপত্র দেখলেন এবং এমন মেধাবী ছাত্রকে ফিরিয়ে না দিয়ে ফরম পূরণ করে জমা দিতে বল্লেন। এবারও ভর্তী পরীক্ষায় প্রথম হলেন আব্দুল মালেক। প্রথমে জিন্নাহ হলে সিটের আবেদন করে না পাওয়ায় ড.কামাল হোসেন স্যার পরে ফজলুল হক হলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে ফজলুল হক হলে ১১২ নং কক্ষেই কাটিয়েছেন তিনি। অবশেষে আরেকটি কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই ইবলিসের ষড়যন্ত্রে অকালেই নিভে গেল এ অদম্য মেধাবীর প্রাণ। কবি 

ফররুখ আহমদের ভাষায়-
“ইবলিসের ষড়যন্ত্রে
নিভে গেল অকালে যে প্রাণ
জান্নাতের ফুল হয়ে
ফুটেছে সে এখন অম্লান।”



(পর্ব-৩)

“ইকামাতে দ্বীনের কাজকে অগ্রাধিকার”
“পৃথিবীর হাজারও কাজের ভীড়ে 
ইকামাতে দ্বীনের এ কাজ যেন,
সবচেয়ে প্রিয় হয়।
আর কোন বাসনা নেইতো আমার
কবুল করো তুমি
হে দয়াময়।”

হ্যা, সত্যিই পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের কাজকেই সবচেয়ে বেশী প্রিয় করে নিয়েছিলেন শহীদ আব্দুল মালেক। দ্বীনকে তিনি অন্যতম নয় বরং একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হিসেবে যা কিছু সামনে এসেছে তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। স্কুল জীবনে তিনি লজিং থাকতেন মৌলভী মহিউদ্দিন সাহেবের বাসায়। মহিউদ্দিন সাহেব গাইবান্ধায় এক সেমিনারে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুর রহিম আলোচিত “জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত”বিষয়টি সকলকে বুঝানোর সময় অনুসন্ধিৎসু শহীদ আব্দুল মালেক প্রশ্ন করেছিলেন ‘চাচা, এ পথের সন্ধান কিভাবে পাওয়া যায় ? হ্যাঁ এ পথের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন বলেই বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তী হয়েই বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন, “বাড়ির কথা ভাবিনা, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন।কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ,দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না,শুধু মাত্র যেন প্রকৃত মানুষরুপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।”কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেন তখন তার এ সংকল্প আরও দৃঢ় হল। তাইতো ফজলুল হক হলের তার রুমের দরজার উপর লিখে রেখেছিলেন শহীদ সাইয়েদ কুতুবের সেই বিপ্লবী বাণী“আমরা ততদিন পর্যন্ত নিস্তব্ধ হবনা, নীরব হবনা, নিথর হব না, যতদিন না কোরআনকে এক অমর শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাই। আমরা এ কাজে হয় সফলতা অর্জন করব নয় মৃত্যবরণ করব।” এ মহান মঞ্জিলে পৌছার জন্য মায়ের বন্ধনও ছিন্ন করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন “মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশীর্বাদ করবেন।সত্য প্রষ্ঠিার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি। আমার মা এবং ভাইরা আশা করে আছেন আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি বড় হতে চাইনে, আমি ছোট থেকেই স্বার্থকতা পেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত থেকে ফিরে যদি বাতিল পন্থীদের পিছনে ছুটতে হয় তবে কি লাভ ?
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোর চেয়ে ইসলামী ছাত্র সংঘের অফিস আমার জীবনে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। জানি আমার কোন দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কি বলুন ? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করব নচেৎ সে চেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রান ভরে আশির্বাদ করুন জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের নিরন্ধ্র অন্ধকার,সরকারী যাঁতাকলের নিষ্পেষণ আর ফাঁসীর মঞ্চও যেন আমায় ভড়কে দিতে না পারে।”

লেখকঃ (শহীদ আব্দুল মালেকের ভাতিজা)
ডাঃ আনোয়ারুল ইসলাম
সভাপতি
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
রাজশাহী মহানগরী

No comments:

Post a Comment